ভ্রমণ ডেস্ক: রাজধানী থেকে খুব বেশি কাছেও নয়, আবার দূরেও নয়, স্বল্প ছুটিতে বেড়ানোর চমৎকার জায়গা শ্রীমঙ্গল। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত শ্রীমঙ্গল চায়ের রাজধানী হিসেবে খ্যাত। এই স্থানটির প্রায় ৪৩ শতাংশ জড়েু চা বাগান। নামের সঙ্গে ‘শ্রী’ একেবারেই যথার্থ; এমনই রূপশ্রী শ্রীমঙ্গল যে একবার দেখলে বারবার দেখতে মন চাইবে। আমাদের আজকের গন্তব্য শ্রীময়ী শ্রীমঙ্গলে। চলুন তবে জেনে নেই শ্রীমঙ্গলে বেড়ানোর খুটিনাটি।
ঢেউ খেলানো চায়ের রাজ্যে
শ্রীমঙ্গলে যেদিকেই যান না কেন চা বাগান চোখে পড়বেই। শ্রীমঙ্গল উপজেলার উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো টিলার গায়ে চা বাগানের সৌন্দর্য্য, এক কাপ চা পান করার মতোই আপনার মন সতেজ করে তুলবে। এ সময় চা বাগান কঁচি সবুজ পাতায় পরিপূর্ণ থাকে এবং চাপাতা সংগ্রহের কাজ চলে। ফলে চারপাশে নরম সবুজের সমারোহ ভালো লাগবেই। এখানে চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) নিজস্ব বাগান আছে। কাছাকাছি আছে ফিনলের চা-বাগান। ভানুগাছ সড়ক ধরে কয়েক কিলোমিটার গেলেই দেখা মিলবে জেরিন টি-এস্টেটের। এছাড়া লাউয়াছড়ার কিছুটা আগেই ডান দিকের জঙ্গলঘেরা পথ নিয়ে যাবে নূরজাহান টি-এস্টেটে। এ সময় গেলে চা পাতা তোলা দেখার পাশাপাশি জেনে নিতে পারেন চা শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনকাহিনী। কপালে থাকলে দেখে, শিখে ও চেখে নিতে পারেন চা শ্রমিকদের ঐতিহ্যবাহী চা পাতার ভর্তা ‘পাতিচখা’র রেসিপি; চা পাতার সাথে আরো মেশানো থাকে রসুন, পেয়াজ, মরিচ ও চানাচুর। এটাই তাদের দুপুরের ভাতের সঙ্গে সহজিয়া ব্যাঞ্জন।
মন ভোলানো মাধবপুর লেক
শ্রীমঙ্গলে এসে মাধবপুর লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য না দেখলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। লেকটির অবস্থান কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে। ভানুগাছ সড়ক হয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবপুর লেকের দূরত্ব ২৫ কিমি। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা এ লেকটি উপর থেকে দেখতে অনেকটা বহুপদি এমিবা বা কাঁকড়ার মতো; গুগল থেকে দেখে নিতে পারেন। লেকটির দিকে তাকালে প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে পাড় ঘেঁষে ফুটে থাকা নীল শাপলা ফুল, লেকের কাকচক্ষু জলে আরেকটি আকাশ। টিলায় টিলায় সাজানো সুদৃশ্য চা বাগানে ঘেরা স্বচ্ছ পানির এই হ্রদটি ১৯৬৩ সালে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয় যার দৈর্ঘ্য ৩ কিমি এবং গড় প্রস্থ ১৭৫ মিটার।
মাধবপুর লেকে গাড়ির জন্য পার্কিং ও পাস চার্জ দিতে হয়, কিন্তু প্রবেশ ফি নেই। মাধবপুর লেক সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
মাধবপুর লেক থেকে বের হতে হতে একটা মজার তথ্য দেই, প্রমাণ সাইজের চা গাছ দেখতে পাবেন লেকে ঢোকার কিছুটা আগে হাতের বাঁয়ে; আর ঠিক ডানে দেখতে পাবেন শিশু চা গাছ- মানে চা চারার নার্সারি। বোনাস তথ্য, এখানে লেমন গ্রাসের কিছু ঝোঁপ আছে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সবুজ আলো
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য। এটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই বনে দেখা মেলে নানা বিরল প্রজাতির পশুপাখির। আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল ধরে ঘুরে দেখতে পারেন পাহাড়ি টিলাঘেরা, বনলতায় আচ্ছাদিত সবুজ বনানী। ছমছমে শুড়িপথ সবুজাভ আলোয় আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে এক অপার্থিব জগতে। নিসর্গ ভ্রমণের জন্য এর থেকে সেরা আর কিছু হয় না। বুনোপথের দু’পাশ জুড়ে চোখে পড়বে, কীটপতঙ্গ, নানারকম গাছপালা; ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মিলতে পারে উল্লুক আর চশমা হনুমানের। ট্রেইলে ট্রেকিং এর জন্য গাইড ভাড়া পাবেন এখানে। বনের ভেতরে বেশকিছু পাহাড়ি ছড়াও রয়েছে যার একটির নামেই এই বনের নাম ‘লাউয়াছড়া’।
বনের ভেতর হারিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ পেয়ে যেতে পারেন রাবার বাগান, লেবু বাগান অথবা একটি ছড়া। ছড়ার পানিতে পা ভিজিয়ে চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে যদি ঢুকেই যান কোনো পান বাগানে দেখে নিতে ভুলবেন না সংলগ্ন খাসিয়াপুঞ্জি। পান যাদের প্রধান ফসল ও আয়ের উৎস। হারিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি পছন্দ না হলে সোজা পথেও লাউয়াছড়া পার হয়ে খাসিয়াপুঞ্জিতে যেতে পারেন।
এই বনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি আছে তা হলো বনের বুক চিরে বয়ে চলা রেল লাইন। যেখানে হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ এবং হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’-এর শুটিং হয়েছিল। পুরো লাউয়াছড়া বন ঘুরে দেখার জন্য ২-৪ ঘণ্টা সময় যথেষ্ট। লাউয়াছড়া বনে ঢুকতে হলে প্রাপ্ত বয়স্কদের জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা ছাত্রছাত্রীদের জনপ্রতি ২০ টাকার টিকেট কিনতে হবে।
পাখপাখালির বাইক্কা বিল
আপনার ভ্রমণের সময়টা যদি শীতকাল হয়ে থাকে এবং আপনি যদি পাখিপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে আরেকটি গন্তব্য হতে পারে বাইক্কা বিল। দেশি-বিদেশি বহু জাতের পাখির দেখা মেলে এই বিলে। পড়ন্ত বিকেলে পাখির ঝাঁকের উড়ে বেড়াবার দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। এছাড়া অনেক সময় পদ্ম ফুলেরও দেখা মেলে এই বিলে। দর্শনার্থীদের জন্য এখানে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার।
সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা
সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা আরেকটি মজার জায়গা। নানা প্রজাতির পশুপাখি দেখবেন এই সুন্দর পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া চিড়িয়াখানায়। বিশেষ করে নজর কাড়বে চকচকে কালো পশমের ভালুক। সাথে গুরুগম্ভীর ঈগল প্রজাতির পাখি আর ভদ্রগোছের কিছু লেজ ঝোলা বানরের দেখাও পাবেন এখানে।
শহরে একটি রাবার বাগান আছে, এই পথ ধরেই যেতে হবে সাতরং চায়ের দোকান ‘নীলকণ্ঠ টি কেবিন’ এ আর রামনগর মণিপুরী পাড়ায়- তাদের বানানো বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখতে ও কিনতে। সাতরং চা খেতে কেমন সে আপনার বিবেচ্য, তবে মণিপুরী তাঁতবস্ত্র যে খুবই মনোহর সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, বিশেষ করে মণিপুরী শাল, মনিপুরী শাড়ি, ওড়না বা গামছা। বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রেরও দেখা মিলবে এখানে।
শ্রীমঙ্গলে আরো আছে চা জাদুঘর, বিজিবি পার্ক, লাল পাহাড়, হামহাম ঝরনা, লাসুবন গিরিখাদ, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ; ভ্রমণের ব্যপ্তিকাল ও পছন্দ অনুযায়ী ঠিক করে নেবেন কোন কোন জায়গা আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখবেন।
যাওয়া আসা
ঢাকা থেকে সড়ক এবং রেলপথে সরাসরি শ্রীমঙ্গল যাওয়া সম্ভব। উভয় পথেই সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। এ রুটে হানিফ, এনা, শ্যামলী পরিবহনসহ অন্যন্য বেশ কিছু বাস চলাচল করে। নন এসি এবং এসি বাসগুলো সায়েদাবাদ এবং ফকিরাপুর থেকে ছেড়ে যায়। অন্যদিকে পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস এবং উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আপনাকে শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নামতে হবে। বুধবার ব্যতীত সপ্তাহের ৬ দিন রাত ৮টা ৩০ মিনিটে উপবন এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা থেকে রাতের বেলা উপবন এক্সপ্রেস কিংবা ১১টার বাসে করে রওয়ানা দেওয়াই ভালো। শ্রীমঙ্গলে পৌঁছানোর পর সিএনজি, জিপ কিংবা বাসে করে কাঙ্ক্ষিত স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পারবেন। ৪ জনের জন্য সিএনজি রিজার্ভ করতে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা এবং ১০ জনের জন্য জিপ রিজার্ভ করতে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা লাগবে।
অস্থায়ী নিবাস ও আহার
শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্যে রয়েছে বেশ কিছু সুন্দর মনোরম রিসোর্ট। অনেক কটেজ ও সরকারি বেসরকারি গেস্ট হাউজও আছে। শ্রীমঙ্গল শহরেও রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল। একটু খোঁজ নিয়ে আপনার চাহিদা ও বাজেট অনুযায়ী পছন্দ করতে পারেন।
শ্রীমঙ্গলের রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে পানসী এবং পাঁচ ভাই বেশ জনপ্রিয়। হরেক রকম ভর্তা, সবজি, মাছ এবং মাংস পেয়ে যাবেন এসব রেস্তোরাঁয়। এছাড়া বাস স্টেশনের কাছে আরো কিছু খাবার হোটেল পেয়ে যাবেন।